আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। আসছে বাজেটের আকার চলতি বছরের চেয়ে আরও বড় হবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। শোনা যাচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের তুলনায় এর আকার প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে। আগামী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে নতুন বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। তবে এবারের বাজেটের আকার বড় হবে নাকি ছোট হবে তা নিয়ে সংশয়ের মধ্যে আছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ পুরো বিশ্বের মতো অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ। ফলে আগামী বাজেটের বহুমুখী চালেঞ্জ থাকবে। নির্বাচনী বছর হওয়ায় আগামী বাজেট সরকারের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে অর্থনীতির দু’একটি সূচক ছাড়া সব সূচকই নি¤œমুখী। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের চাপ, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধ, ব্যাংক ঋণের লাগাম টানা, বাজেট ঘাটতি পূরণ, আইএমএফ শর্ত পূরণের চাপ ও ক্রমান্বয়ে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইত্যাদি বিষয়গুলো সরকারকে ফেস করতে হবে বলে মনে করেন তারা। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমাগত ডলার সংকট আগামী বাজেট প্রণয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকে বেশ কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তাতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীলতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলা, অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট নিয়ে অনেক প্রস্তাব আসছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পুরো সামষ্টিক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে আছে, যা আমাদের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার ডলারের সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। ডলার সংকট যতদিন থাকবে, পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত হবে না। একই সঙ্গে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি-কোনোটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বাজেট ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের উচিত বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা এবং কাঠামোগত সংস্কার করা। তবে উচ্চমূল্যস্ফীতি ও ক্রমাগত ডলার সংকট আগামী বাজেট প্রণয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
রাজস্ব আদায়: বাজেটের খরচের ৮০ শতাংশের বেশি জোগান দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আছে এনবিআর। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২২ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এ বছরও ৪৫-৫০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব ঘাটতি থাকতে পারে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ ডলার সংকট ও আমদানিকৃত কিছু পণ্যে কর অব্যাহতি এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। এ রকম চলতে থাকলে আইএমএফের শর্ত পূরণে ব্যাঘাত ঘটবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের অর্থনীতিতে চলমান নানা অব্যবস্থাপনার কারণেই রাজস্ব আদায়ে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
ব্যাংক ঋণ: ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ বাড়ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে খাতটিতে সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৯৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। আগের অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেয়ার লক্ষ্য সরকারের। এদিকে, চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকেও ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।
বৈদেশিক ঋণ: চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এবং অর্থছাড় কমেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি ৬৩.১৯% কমে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল ৪.৮৪ বিলিয়ন ডলার। এদিকে, ২০২৩ অর্থবছরের আট মাসে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় কমেছে ৪.৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ অর্থবছরের একই সময় ছিল ৫.৮৯ বিলিয়ন ডলার। গতবারের তুলনায় এবার অর্থছাড় কমেছে ১৭%।
রিজার্ভ ও ডলার সংকট: গত বছরের এপ্রিল থেকেই ডলারের দাম বাড়তে থাকে। তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, যা এখন গড়ে ১০৫ টাকার বেশি। বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি করতে গিয়ে রিজার্ভ কমে যায়। যে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের, তা এখন ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারে ঘরে নেমেছে।
মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ: আগামী বাজেটে অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা। চলতি অর্থবছরের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৭৮ শতাংশ। অথচ চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫.৬ শতাংশ।
আইএমএফের শর্ত পূরণ: আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসেবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব খাতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এ সময়ে জিডিপি’র অতিরিক্ত ০.৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ থাকতে হবে। বিভিন্ন সময়ে দেয়া বিভিন্ন খাতের করছাড়ও কমাতে হবে। চলতি বাজেটে ২০ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হবে। ফলে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আইএমএফের শর্ত পালন করাও কঠিন হবে। শর্ত অনুযায়ী ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিকল্প হিসেবে চালু হবে বাজারভিত্তিক সুদের হার। সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া আছে।
প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়: অর্থনীতির সব সূচকের মধ্যে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় এখনো ভালো অবস্থানে আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই- ফেব্রুয়ারি) ১ হাজার ৪০১ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৮ কোটি ডলার বেশি। রপ্তানি আয়েও ভালো অবস্থা। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশের মতো।
গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। যেহেতু আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক নয় এবং রাজস্ব আদায়ও কম, তাই করের আওতা বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি ট্যাক্স অটোমেশন, কর ব্যবস্থার সরলীকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। আগামী বাজেটে করণীয় উল্লেখ করে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য, রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবণতা, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি, ব্যাংকে তারল্য ও ডলার সংকট, আর্থিক খাতের ভারসাম্যহীনতা, রিজার্ভ হ্রাস-এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতিতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা আনতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির চাপের কেন্দ্রে আছে রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি। এর মধ্যে আইএমএফের শর্ত আছে। রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে। আগামী বাজেটে মানুষের ওপর এই চাপ কমানোই সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।