সিলেটে ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। তছনছ করে দিয়ে গেছে উজানের তীব্র ঢল। সীমান্তবর্তী ৫ উপজেলার বেশির ভাগ সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছোট-বড় গর্তে পরিণত হয়েছে গ্রামীণ সড়ক। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে এসব ক্ষতচিহ্ন এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করছে প্রশাসন। ২৬শে মে উজানের ঢলে হঠাৎ বিপর্যয় ঘটেছিল সিলেটে। লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়ে পানিবন্দি। উজান থেকে আসা ঢলের তীব্র স্রোতের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন সবাই। সড়ক, বাসাবাড়ি, লোকালয়ের উপর দিয়ে তীব্র বেগে পানি প্রবাহিত হয়েছে।
বাড়িতে আটকা পড়া মানুষজনকে উদ্ধারে প্রশাসনসহ স্থানীয়দের বেগ পেতে হয়। এক সপ্তাহে মাথায় এসে অনেক স্থানে বন্যার পানি নামছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ মানবজমিনকে জানিয়েছেন; ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঢলের তোড়ে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে- উজানের ঢলে ১৫-১৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখনো পানি বিদ্যমান থাকায় অনেক স্থানে ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি। এদিকে, সিলেট-তামাবিল সড়কের ৪নং বাংলাবাজার এলাকায় কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢলের পানি আঘাত হেনেছিল। ফলে ওই রুট নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন অনেকেই। প্রবল বেগে ওই রুটের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। ব্রিজের অ্যাপ্রোচের ক্ষয়ক্ষতি হলেও সড়কের কোনো ক্ষতি হয়নি। জৈন্তাপুরে কম হলেও ১০টি গ্রামীণ রাস্তা ঢলের তোড়ে তছনছ হয়ে গেছে। জৈন্তাপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, জৈন্তাপুরে স্রোত এতটাই বেশি ছিল রাস্তাঘাট, বেরিবাঁধ সবই পানির তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বহু এলাকার সঙ্গে এখনো সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি।
তিনি জানান, বাউরবাগ থেকে মল্লিকপুর সড়ক, গোয়াবাড়ি সড়ক, কমলাবাড়ি সড়ক, লক্ষ্মীপুর সড়ক, ডুণ্ডিরপাড় সড়ক, সারিঘাটের ওয়াপদা বেরিবাঁধ সড়কের কয়েকটি স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢলের তাণ্ডবে এসব সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। গোয়াইনঘাটে সবচেয়ে বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে সদর-সোনারহাট সড়কের কমপক্ষে ১০ থেকে ১২টি স্থানে বড় বড় গর্ত হয়েছে। গত শুস্ক মৌসুমে এই সড়কে কাজ হয়েছিল বলে সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া জানিয়েছেন। এবারের তিনদিনের ঢলে পুরো সড়কই এখন ক্ষতচিহ্ন। গোয়াইনঘাট-রাধানগর ও সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সদর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলায় ইজিপিপি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে প্রায় ৩ শতাধিক প্রকল্পে ২৮০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ ও পুরাতন মাটির সড়ক সংস্কার করা সম্ভব হয়েছিল বলে জানিয়েছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) শীর্ষেন্দু পুরকায়স্থ। গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস কামরুল হাসান আমিরুল জানিয়েছেন, আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলাটি সিলেট বিভাগের সর্ববৃহৎ উপজেলা। উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বর্ষণে উপজেলাটি প্রতিবছর ছোট-বড় অন্তত ১০-১২টি বন্যার শিকার হয়।
এবারো এই উপজেলার বেশিরভাগ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি। কোম্পানীগঞ্জে খাগাইল-কায়েফগাঁও সড়কের কয়েকটি স্থান ঢলের তোড়ে ভেঙে গেছে। এ ছাড়া- ইছাকলস, দক্ষিণ রনীগাঁও ইউনিয়নের ৫-৬টি সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এদিকে- কানাইঘাট-গাছবাড়ি-হরিপুর সড়ক এখনো পানির নিচে। এ রুটটি আরসিসি ঢালাই করা। ফলে তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকলেও উভয়পাশে সড়কের অ্যাপ্রোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুরহানউদ্দিন সড়কের কানাইঘাট অংশে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মুখীগঞ্জ থেকে ফাইলজুড় ডাইক ও সড়কের ৭-৮টি স্থানে পানি উঠে যাওয়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কানাইঘাটে চতুল-বড়বন্দ-সুরইঘাট সড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েকটি স্থান পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। জকিগঞ্জ পৌরসভার কুশিয়ারা ডাউক বন্যার তোড়ে ভেসে যায়। এতে কয়েকটি স্থান ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢোকে। এ কারণে এই সড়ক ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছে। এ ছাড়া বারহাল ও বিরশ্রী ইউনিয়নের অধিকাংশ সড়ক এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলররা জানিয়েছেন- জকিগঞ্জ সদরে সুরমার ডাইক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বাইরে চবরিয়া, নরসিংহপুর, নোয়াগ্রাম, বাল্লাসহ কয়েকটি এলাকার সুরমা ও কুশিয়ারা ডাইক ভেঙে গেছে।
নদী খননের দাবি: বৃহত্তর সিলেট গণদাবি পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির নিয়মিত সাপ্তাহিক সভায় বক্তারা সুরমা, কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদী খননের দাবি তুলেছেন। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি এডভোকেট আব্দুল খালিকের সভাপতিত্বে ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মো. বদরুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের পরিচালনায় সভায় বক্তারা বলেন, বৃষ্টি শুরু হলেই সিলেট মহানগরের বাসাবাড়ি ডুবে যায়। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ উপজেলা বন্যা প্লাবিত হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ সিলেট বিভাগের নদী সমূহ নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। জরুরিভিত্তিতে সুরমা, কুশিয়ারা, মনুসহ সকল নদী, খাল ও নালা খনন করার জোর দাবি জানান। সিলেট বিভাগের বন্যাকবলিত এলাকাকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণের জোর দাবি জানান।